আমি খুব অসহায় বোধ করছি, স্বজন হারানোর কষ্ট অনুভব করছি। মানসিকভাবে কে কার কতটা আপন তা কেবল কারও চলে যাবার পর আরও স্পষ্ট হয়। সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রয়মারের চলে যাওয়াটা এ রকম একটা বেদনাদায়ক ঘটনা আমার জন্য।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। জন্মেছিলেন ১৯৩১ সালে। তিনি কবি হিসেবে আমাদের শামসুর রাহমানের সমসাময়িক ছিলেন। রাহমান ভাই জন্মেছিলেন ১৯২৯ সালে। সুইডিশ একাডেমি ২০১১ সালে ট্রান্সট্রয়মারকে কবিতার জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়ে সন্মানিত করে। এর আগেই তাঁর কবিতা বাংলাসহ ৬০-এর মতো ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। তিনি সারা দুনিয়ার কবি ও কবিতার পাঠকের কাছে সমাদৃত ছিলেন। সুইডিশ একাডেমি ট্রান্সট্রয়মারকে পুরস্কৃত করে একাডেমিকেই সন্মানিত করেছিল।
এ রকম একজন বিরলপ্রজ কবিতার দিকপালের কাছাকাছি আসার সুযোগ হয়েছিল আমার। এমনিতেই বিদেশজীবনে একপা আমার বাংলাদেশে, আরেক পা সুইডেনে। আর এর নামই বুঝি নির্বাসন। এ রকম দ্বিধান্বিত সময়ে ট্রান্সট্রয়মারের সঙ্গে যোগাযোগ আমাকে কবিতার প্রতি বেশি বেশি অনুরাগী হতে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
২০০৪ কি ২০০৫ সালে অনুবাদক লিয়াকত হোসেন স্টকহোমে একটা কবিতা সন্ধ্যার সূত্র ধরে ট্রান্সট্রয়মারের কবিতার প্রশংসা করে একটা মেইল করেছিলেন। আমি তখন ঢাকার নিউএজ পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। এরপর আমি যখন ২০০৬ সালে নরওয়ের কবি হেনরিক ইবসেনের কবিতা অনুবাদ করছিলাম, কবি বেলাল চৌধুরী আমাকে ট্রান্সট্রয়মারের কবিতার কথা বলেছিলেন| এই দুটি ঘটনা ট্রান্সট্রয়মারের প্রতি আমাকে আগ্রহী করেছিল। এরপর সেই সময়ে আমার বন্ধু ঢাকায় সুইডিশ কূটনীতিক আমাকে ট্রান্সট্রয়মারের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ সমগ্র উপহার দেন। সেই সমগ্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি পড়ে আমি সম্মোহিত হয়ে যাই।
শিরোনামহীন
জেগে ওঠা তো স্বপ্নের ভেতর থেকে
সকালের সবুজ দেশে মুক্ত পর্যটকের
শ্বাসরুদ্ধকর উদ্দামে প্যারাসুটে
লাফ দেওয়া।
জিনিসেরা জ্বলে ওঠে।
শিহরিত ভরতপাখির মতে–
পর্যটক জানে বৃক্ষের ভূতলে ব্যাপক
শিকড় জংশন
আর দোলানো বাতিবৃত্তান্ত।
কিন্তু ভূস্তরের সবুজ দারু
মৌসুমি বন্যা
যেন তার উত্তোলিত বাহু
অদৃশ্য পাম্পের শব্দ চারু।
পর্যটক যেন গ্রীষ্মের দিকে পা মাড়ায়
দৃষ্টিসন্তাপক অগ্নিগিরির জ্বালামুখ নেমে যায়
যুগে যুগে সূর্যের সঞ্চালক চাকার
নিচে ভেজা সবুজ বৃক্ষের বাণের মাধ্যমে
পর্যটক নেমে আসে
এ যেন পরীক্ষিত, পতনমুখী ক্ষণিক যাত্রা
হুড়মুড়ে চলা জলের উপরে
বাতাসে ভেসে থাকা
বাজপাখির বাহাদুরি
পর্যটকের ব্রোঞ্জযুগের তুরী।
অচল নোট। অতল গভীর বাতাসে
ভেসে থাকা।
দিনের প্রথম প্রহরে স্মৃতিরা
দুনিয়াকে শক্ত করে আঁকড়ে টাকড়ে ধরে
যেমন করে রোদ তাজা পাথরকে হাতে করে
পর্যটক শেষতক বৃক্ষের নিচেই দাঁড়িয়ে পড়ে।
মৃত্যুর উদ্দামতার সংঘর্ষের পড়ে
বড় কোনো আলো কি তার মাথার উপর
আঁচড়ে টাচড়ে পড়ে?
২০০৮ সালে স্টকহোমে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সামনাসামনি আলাপ হয়।
১৯৯০ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে তিনি কর্মক্ষমতা ও বাকশক্তি অনেকটা হারিয়ে ফেললেও তাঁর স্ত্রী মনিকার মাধ্যমে আলাপচারিতা চালাতেন।
সব মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ১১ এবং আমেরিকান কবি রবার্ট ব্লাইয়ের সঙ্গে পত্রগুচ্ছ। তবে তাঁর অপ্রকাশিত কবিতার বিশাল এক ভাণ্ডার তিনি বাক্সবন্দি করে রেখেছেন।
২০০৯ সালে আমি সুইডিশ শহর উপসালায় আবাসিক লেখক বৃত্তি গ্রহণ করার ট্রান্সট্রয়মার দম্পতির আমন্ত্রণে ভেস্তেরস শহরে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এরপর তিনি ২০১০ সালে উপসালা নগর গ্রন্থাগারে আমার লেখালেখি কর্মশালায় অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে আমাকে সম্মানিত করেছিলেন।
নোবেল পুরস্কারের পরও টেলিফোনে এবং মেইলে যোগাযোগ ছিল। যদিও তাঁর স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিল না।
১৯৬০ এর দশকে একটি চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের সৌন্দর্য দেখ মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন| কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠেনি| আর যখন সুযোগ হল তখন স্বাস্থ্য তাঁর পক্ষে রইল না|
ট্রান্সট্রয়মার দম্পতির কাছ থেকে জীবন কবিতা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি| তবে সবচেয়ে সেরা জানলাম, কীভাবে নির্মোহ আর উদার হয়ে জীবনের সুন্দরের দেখা পাওয়া যায়| তাঁর কবিতায় সেই জয়গান তিনি গেয়ে গেলেন|
তিনি ২৬ মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন|
ট্রান্সট্রয়মার, স্বর্গেও আপনার কবিতা ও মেটাফরের জয় হোক|
[আনিসুর রহমান, উপসালা, সুইডেন। www.anisur.net]
প্রথম প্রকাশ: আর্টস বিডি নিউজ ২৪ http://arts.bdnews24.com/?p=6480
0 kommentarer:
Post a Comment